নাট্য ও অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন
‘নীলদর্পণে’র অভিনয়ের পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার ভীত হচ্ছিল। অভিনেতারা রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই সমগ্র জাতির, মনে সুপ্ত চেতনাকে বাড়িয়ে তুলতে চেয়েছিল। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে নীলকর সাহেবদের অমানবিক অত্যাচার, জোর করে দাদন দিয়ে কৃষকদের নীল বুনতে বাধ্য করা প্রভৃতি হৃদয়বিদারক ঘটনা অভিনয়ের মাধ্যমে জাতির মনে ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে দর্শকবৃন্দের মনে স্বদেশপ্রীতি জাগত হল। এর ফলে ইংরেজ সরকার ক্ষুব্ধ হল নাটক ও অভিনেতাদের উপর। ইংলিশম্যান কাগজে এই নাটকটির অভিনয় নিয়ে তীব্র আপত্তি করা হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসুর আবির্ভাবের পূর্বেই রঙ্গমঞ্চগুলিই জাতীয়তাবাদের জোরালো মন্ত্র উচ্চারণ করেছিল। ১৮৭৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল ও গ্রেট ন্যাশনালে যথাক্রমে মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘সরোজিনী’ ও ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ প্রহসন। এরপর অভিনেতারা মঞ্চস্থ করলেন ‘দি পুলিশ অব্ পিগ এন্ড শিক্ষা’ নামক প্রহসনটি। এতে পুলিশ সমাজকে ব্যঙ্গ করা হয়। এর ফলে ইংরেজ সরকার নাটক ও মঞ্চকে নিয়ন্ত্রিত করবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। এবং ১৮৭৬ সালে নাট্যনিয়ন্ত্রণের জন্য অর্ডিন্যান্স জারী করেন। বাংলা নাটক ও অভিনয়ের কণ্ঠ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার এদেশে ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ চালু করে। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে এই আইনটি চালু হয়। এই আইন চালু হওয়ার ফলে বাঙালি মানসে স্বাধীনতার স্বপ্ন দৃঢ় হতে থাকে। তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই সভা, সমিতি, আলোচনা, কাব্য, উপন্যাস প্রভৃতিতে।
ড. পুলিন দাস তাঁর ‘বঙ্গরঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক’ গ্রন্থে বলেছেন—২৭ ও ২৮ জুলাই ১৮৭৫-এর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার সিদ্ধান্ত শাসকমহলে গৃহীত হয়েছে। আপত্তিকর নাটকের দৃষ্টান্তরূপে দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘চাকর দর্পণ’ নাটক ও আপত্তিকর অভিনয়ের নজির হিসেবে গাইকোয়ার এর বিচার সংক্রান্ত ‘গুঁইকোয়ার নাটক’ এর ২২ মে, ১৮৭৫-এ বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনীত প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে। ‘চাকর দর্পণ’-এর উল্লেখ প্রসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের কথাও। অবশেষে নাট্যনিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া উপস্থিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অতঃপর ২ আগস্ট, ১৮৭৫-এ ভারত সরকারের হোম ডিপার্টমেন্টের অফিসিয়েটিং সেক্রেটারি এ হাওয়েল লেজিস্লেটিভ্ ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারির কাছে নাট্য ও মঞ্চ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনের খসড়া প্রস্তুত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এরপর বিলেতে ভারতসচিবের নিকট নাট্যনিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন প্রবর্তনের অনুমোদন চেয়ে পাঠানো হয়। বিলেতে প্রবর্তিত নাট্যনিয়ন্ত্রণের বিধিবিধানের অনুকরণ, পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার সংস্পর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মপ্রকাশ এর জন্য তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সাহিত্য, নাটক ও মঞ্চেই যে মুক্তির পথের বাহন তা স্বভাবতই তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। মঞ্চে অভিযোগের মাধ্যমে সমাজের কুপ্রথার কুফলগুলি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলার প্রয়াস দেখা যায়। কৌলিন্যের কুফল, বহুবিবাহের ঘৃণ্যতা, বৈধব্যের করুণ ব্যর্থতা, প্রবীণ ভণ্ড তপস্বীর নির্লজ্জ লাম্পট্য ইত্যাদি সমাজের করুণ অবস্থাগুলিকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মানুষকে জানাতে চেয়েছে। নাট্য ও অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে জনমানসে স্বদেশপ্রীতি জাগ্রত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তা জোরকদমে অগ্রসর হয়েছিল। ১৫ মার্চ, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে নাট্যনিয়ন্ত্রণ বিল সুপ্রিম লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে উত্থাপিত হল। বড়লাট লর্ড লিটন বিলটিতে স্বাক্ষর করে আইনে পরিণত করলেন।
